Monday, May 3, 2010

KIRIBURUR NAAM DILAM PUGMARKS

কিরিবুরুর নাম দিলাম পাগমার্কস

Bear-footprint

তখনও ‘মুলা রুজ’ উচ্চারণ করতে শিখিনি। পাহাড় চুড়ো মঁ ব্লাঁ’র নাম শুনলেও পেনের নামটা মাউন্ট ব্ল্যাঙ্কই পড়তাম। ‘জাঙ্ক ফুড’ শব্দটাই ছিল না-শোনা। ন্যাশনালে প্রতিদিনের হচপচ (ডিম তরকা আর মাংসের ঝোলের খিচুড়ি), ঘুগনী গলি, নেতাজী কেবিন থেকে ফুরসতই মেলা ছিল মুসকিল। বেদুইনের রোল তখনও টানতে পারেনি আমাদের উত্তুরে লোলুপ জিভকে। স্বপনদা, শ্যামলদার রোলের স্বাদই তখন লেগে থাকে সর্বক্ষণ। কারো কোনো কাজ সেরে দেবার ‘পারিশ্রমিক’ হিসেবে মাঝে মধ্যে অনাদির মোগলাই। কখনও সখনও ডেকার্স লেনে চিত্তদা’র ‘স্টু’। কারো জন্মদিনে বড়জোর চাচার হোটেল নয়তো প্রিন্সেপ ঘাট স্টেশনের গার্ডন রেস্টুরেন্ট। নীলার ওপরের ঘরে হ্যাম-স্যাণ্ডউইচ (ব্যবস্থাপনায়: অনীশা), সেও আরো কয়েক বছর পরের কথা।

একবার অনুপমের দিদির এমনই একটা কাজের ‘পারিশ্রমিক’ অনাদির মোগলাইয়ের টাকা সিনেমা আর সিগারেট ফুঁকেই শেষ। অগত্যা দু’জনের ভুখা পেটের দাওয়াই ময়দানে ট্রাম লাইনের ধারে খোট্টা ছাতুয়ালার বিষ-টক আচার সহযোগে ছাতু মাখা— একেবারেই শ্রমিক শ্রেণীর খানা।

বলছি, সেই বাউণ্ডুলে সাজার সময়কার কথা।

সিনেমাটা দেখা হলেও সাদা-কালো অক্ষরে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ তখনও পড়া হয়নি। সন্দীপনের ‘জঙ্গলের দিনরাত্রি’ তো কোন ছাড়! বলছি, সেসময়ের কথা, যখন স্ট্যাণ্ডে স্ট্যাণ্ডে ট্র্যাভেল ম্যাগাজিনের এমন ছড়াছড়ি হয়নি। সেই অল্প জানা আর অনভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই এক রাতে উঠে পড়লাম খড়্গপুরের ট্রেনে, ফিজিক্সের এইচ এস-এর উসকানিতে। ঐ একটা মানুষ, যত না ফিজিক্সের থিয়োরি পড়িয়েছেন, তার চেয়ে ঢের বেশি মন্ত্রের মতো মুখস্ত করিয়েছেন, উচ্ছ্বল, উদ্দাম হয়ে বেঁচে থাকাটাই জীবন।

সেই হরিশ সরকারের বাতলে দেওয়া আইটিনিয়ারি মেপে লোকাল ট্রেনের টিকিট হাতে চড়ে বসলাম আমেদাবাদ এক্সপ্রেসের সংরক্ষিত কামরায়। শুরুতেই গচ্চা। অঙ্কটা এখনও মনে আছে পাঁচ-ঊনিশে পাক্কা পঁচানব্বই টাকা। সেদিনের বাজারে অনেকটাই। টিটি’র হিসেবটা শুনে তখন হাতের তাশ ফেলে বাইপাস খুঁজছি। যদু হঠাৎই ক্যাশিয়ার সিমলাইকে বললো, নে একশো টাকা বের কর। সেই নোটটা দু-আঙুলের ফাঁকে রেখে নাচাতে নাচাতে বললো, রশিদ কাটুন। আমাদের মুখগুলি ততক্ষণে কার্টুন-পাঁচ। রশিদ পকেটে এমনভাবে ঢোকালো যেন মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড সামলাচ্ছে। বললো, ড্যাব ড্যাব করে দেখছিস কী? ও ফোর নো-ট্রাম কল দিয়েছে। —আরে বাবা, একদিন নয় খাবো না!

এই একটা ডায়লগই যেন রাতভর খড়্গপুর স্টেশনে বঙ্গো, বাঁশি, মাউথ অর্গান যুগলবন্দীর মজলিশের সুরটা বেঁধে দিল। গোড়াতেই একদিনের খাবারের টাকা খুইয়েও উৎসাহে কোনো ভাটা পড়লো না। তার ফুরসতই বা ছিল কই? জামা-কাপড়ের থেকে তো বাজনার বন্দোবস্ত বেশি ছিল। সিমলাইয়ের বাঁশির পুঁটুলিটার ওজন আমার স্যাকের থেকে বেশি ছিল। দেখলে মনে হবে বাজনদারের দল। অথচ পাঁচজনের দলে আমার আর রাজুর গলা চিঁড়ে ফেললেও সুর বেরোবে না, এমন অসুর আমরা। বাপ্পা সৃজনী কালচারাল ফোরামের সদস্য, কিন্তু সুরের ব্যাপারে বড়জোর ঐ ‘নবসাক্ষর’ বলা যায়।

বাজনার সেই লটবহর ছাড়াও সে ট্যুরে আমাদের লাগেজ বলতে এক পেটি ওল্ড মঙ্ক, তিন কার্টুন মত সিগারেট। দু’বোতল ব্লু রিবন জিন, বেশ কিছু নিমকি-চাট আর একটা জলযোগের অর্ডারি কেক। যদুর প্ল্যান, পঁচিশে ডিসেম্বর জমিয়ে সেলিব্রেট করতে হবে।

সেইল গেস্ট হাউসের ভিউ পয়েন্ট থেকে যে পাহাড়সারি দেখা যায় তার সংখ্যা নাকি সাতশো। আমরা যদিও গুণে দেখিনি। সেই সাতশো পাহাড়ের দেশে প্রথম দিনেই আটশো বাধার পাহাড় ঠেলে সেলিব্রশেনের শুরুটা খুব একটা মন্দ ছিল না। অন্য জিনিসের চাপে ভাঙা টুকরো মোমবাতিতেই ক্যান্ডেল লাইট সেলিব্রশন চলছিল ভালোই।

গণ্ডগোলটা বাঁধলো ড্রেসিং টেবিলের ভাঙা আয়নায় যদুর নিজেকে ছত্রিশটা জোকার দেখা থেকেই। ভাসিয়ে দেওয়া টয়লেটে যদুর বমি সাফাই অভিযানে নেমে ঘন্টাখানেকের মধ্যে রাজু আর আমিও নিজেদেরই কাজ বাড়ালাম। পরের কয়েক ঘন্টার সবটাই ডেফার্ড রানিং কমেন্ট্রি। ভাষ্যকার বাকি দু’জন—সিমলাম আর বাপ্পা। ‘কিচেন থেকে খাবার আনতে গিয়ে ওরা বাইরেই আটকা পড়েছিল। তারপর নাকি সিমলাইয়ের অসীম শক্তিতে দরজার তলার দিক ফাঁক করা, সেই ফাঁক গলে তখনও রোগা পাতলা বাপ্পার ঘরে প্রবেশ, ছিটকিনি খোলা...বমির মানচিত্রের মধ্যেই বসে সিমলাইয়ের দিশি মুরগী সহযোগে আমাদের ভাগের রুটিগুলো সাবার করা...’ হুঁশ যখন ফিরলো, অন্ধকারে ঠাওর পাওয়া মুশকিল। হাতরে বুঝলাম, স্যাকটাই এখন মাথার বালিশ, শুধু তার থেকে বেরিয়ে এসে জ্যাকেটটা বনে গেছে স্লিপিং ব্যাগ। তবু ঠাণ্ডা মানানো দায়। হরিশ স্যারের বলে দেওয়া দু-তিন ডিগ্রি যে অতিরঞ্জিত নয়, তা প্রথম রাতেই মালুম পড়লো। অগত্যা নিচের কার্পেটটাকেই লেপ বানিয়ে ফেলা। সারাদিনের ধকল অবশ্য সেই কার্পেট-ওমেই পালিয়ে বাঁচলো।

আগের রাতটা খড়্গপুর স্টেশনে। রাতভর জলসা শেষে ভোরের মিটার গেজ ট্রেন ধরে বড়জামদা। পাইশ হোটেলে লাঞ্চ সেরে বাসের অপেক্ষা আর চলতে থাকলো মাউথ অর্গান জলসা। বাস বলতে মানুষের সহযাত্রী সেখানে ছাগল, মায় মোরগ-মুরগীও। ততদিনে অবশ্য বাউন্ডুলে জীবনে বাসের ছাদটাই আমাদের সুপার বিজনেস ক্লাস হয়ে উঠেছে। বাসের পেটের ভেতরটা তো নিতান্তই ক্যাটল ক্লাস। লটবহর নিয়ে তাতেই যখন চড়তে চলেছি, হাঁক পাড়লেন এতক্ষণ আমাদের পাইস হোটেল জলসার দর্শক-শ্রোতা এক দম্পতি। ভিলাইয়ে সেইলের বড় কর্তা। হয়তো বেশি বয়সে বিয়ে। সুন্দরী স্ত্রী খুব বেশিদিন কলেজ ছেড়েছেন বলে মনে হলো না। হোগলা পাতার মঞ্চে যদু-সিমলাইয়ের সঙ্গতে তিনিও দু’কলি গুনগুনিয়ে দিয়েছেন খানিক আগেই। ওঁরাও যাচ্ছেন মেঘাহাতাবুরু। সেই বৌদির আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সুপার বিজনেস ক্লাসের মায়া ছেড়ে যে সেইলের জিপে উঠলাম, সেটাই আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেলো হোস্টেলের সামনে। সেইলের বড়বাবুরা এখানে থাকে না, ওরা থাকে সাতশো পাহাড়ের দেওয়াল ঘেঁষা এক পাহাড়ের মাথায় অভিজাত গেস্ট হাউসে।

cloud

বলা হয়নি, প্রথম রাতের ঐ আস্তানাটা ছিল আমাদের টেম্পোরারি। হোস্টেল সুপারের নামে যে চিঠিটা পাঠানো হয়েছিল তা নাকি এসে পৌঁছায়নি। অল ইন্ডিয়া রেসলিং কম্পিটিশনের জন্য আজ রাতের জন্য হোস্টেলে ‘নো রুম’। সুপার পাণ্ডেও এখন শীতের ছুটি কাটাতে বাড়ি গেছেন। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেলো, আপাতত সেইলের এই ইউথ হোস্টলের চার্জে রয়েছেন সাম ভট্টাচার্য। সিমলাই আর আমি তাই টাউনশিপের পথে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে একেবারের ভট্‌চাজ্জি মশাইয়ের কোয়ার্টারে। বাঙালী আর কলকাতার ছেলে শুনে উষ্ণ অভ্যর্থনা। বাজার থেকে ফিরতেই ভট্‌চাজ্জি পত্নীর কড়া নির্দেশ— ওদের একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। সেইল কর্তাও কথা না বাড়িয়ে ফোন তুললেন।

যে কেয়ারটেকারের দূর-ছাই শুনে রাজু-বাপ্পা জঙ্গলে ক্যাম্পিং গ্রাউণ্ড খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, ভট্‌চাজ্জি মশাইয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পর সেই ঝাঁ বাবুই হাতে পায়ে ধরতে লাগলেন— আজকের দিনটার মতো ম্যানেজ করে নিন, কাল থেকে আপানারা চাইলে প্রত্যেকে একটা করে করে রুমে থাকুন। আপাতত আজ রাতটা এই ভাঙাচোরা আসবাবের ঘরটা...ভট্‌চাজ সাহাবকে জানাবেন না, প্লিজ। ভাঙাচোরা বলতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা ভাঙা, আর গদিহীন একটা খাট। শুরুতেই আবার জানলার একটা কাঁচ ভেঙে ন্যাচারাল ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করে দিল যদু।

পরের দিন সকালে সত্যিই কথা রেখেছিলেন কেয়ারটেকার ঝাঁ। আমরা অবশ্য আড্ডা মাটি যাতে না হয় তার জন্য মুখোমুখি দুটো ঘরে গিয়েই উঠলাম। ততক্ষণে গোটা মেঘাহাতাবুরুই আমাদের চিনে গেছে। তার পরের দিন সাতেক (এখন মনে নেই, ঠিক কদিন ছিলাম ওখানে) অবশ্য আমরা যেন সেইলেরই অতিথি। ভট্‌চাজ্জি মশাইয়ের আতিথেয়তায় শুধু অবাধ ঘোরাঘুরি, কিংবা ভি আই পি ব্যবস্থাপনায় ওপেন মাইন্স দেখাই নয়, একটা রাতের খাবারও জুটে গেলো তাঁর আমন্ত্রণে, মানে ঘাটতি বাজেটটাকে খানিকটা সামাল দেওয়া আর কী! আর চুটিয়ে প্রকৃতিকে দুমড়ে মুচড়ে নিঙড়ে নেওয়া।

দিন সাতেক প্রকৃতি আর তার বুক খুঁড়ে খনি, সঙ্গে বাঘ থেকে ভূত— বাদ রইলো না কোনো অ্যাডভেঞ্চারই।

ভূমিকাতেই হাজার ছাড়িয়ে গেলো। তাই ধড় তৈরিতে এবার একটু রাশ টানতেই হচ্ছে। হয়তো দেখতে বড় মাথার ল্যাকপ্যাকে সিং হয়ে যাবে, কিন্তু কিছু করার নেই লেখার ইচ্ছেটাও একটু একটু করে কমতির দিকে। তাই পাঠকের বিড়ম্বনা না বাড়িয়ে তড়িঘড়িই শেষ করছি।

বাঘ-ভূত— সব গল্পই অন্য আরেকদিন করা যাবে।

কিরিবুরু-মেঘাহাতাবুরু যাচ্ছি শুনে অন্য বন্ধুরা ঠাট্টা করে সে জায়গার নাম দিয়েছিল কিরিগুরু-মালাইকারি।

ঘুরে এসে আমরা পাঁচজন তার নাম দিলাম— ‘পাগমার্কস’।

বছর তেইশ পর এখন নিজেদেরই গাম্বার্ট মনে হচ্ছে। সারাণ্ডার জঙ্গলে বাঘ নেই তা নয়, তবে...। বনবেড়াল অবশ্য অগুন্তি। সম্ভবত তাদেরই একটাকে ‘বাঘ’ ঠাওরে আমাদের সে কী অ্যাডভেঞ্চারিজম!

1 comment:

  1. About 22 yrs back only I could see the animal watching us from the jungle while we were relaxing by the fire !!!!! You guys never believed me , now see for yourself ,, the footprint is still there !!! Cheers !!

    ReplyDelete